নতুন প্রভাত

ধীমান বসাক

শরীরটা খুব হাল্কা লাগছিল ।বাড়ী ফিরতে বেশ দেরী হয়ে গেল । রাত প্রায় বারোটা বাজে । ঘরে ঢুকেই শুয়ে পড়লাম । আমাকে ঘরে ঢুকতে কেউ দেখেনি । টেবিলের উপড়ে খাবার ঢাকা দেওয়া ছিল, কিন্তু আমার কোন খিদে তেষ্টা ছিলনা । অথচ খেয়েছি সেই কোন সকালে,কলকাতা যাওয়ার সময় ।পাশের ঘরে মা বাবা বলাবলি করছিলো, এতো রাত হয়ে গেলো ধিমু তো এখনো এলো না, ট্রেনের গন্ডগোল নাকি ? ফোনও তো করছে না, যত বার ওকে ফোন করছি বলছে সুইচ অফ । ধিমু আমার ডাক নাম । আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না । আসলে ফোনটা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে
ধস্তাধস্তির সময় ।

সল্টলেকের শিক্ষা দপ্তরের অফিস থেকে ঠিক ছ’টায় বেড়িয়েছিলাম । শিয়ালদা থেকে রাত আটটার শান্তিপুর লোকাল ট্রেন ধরে রাত দশটায় ফুলিয়াতে নেমেছি । গ্যালপিং ট্রেন, তাই পনের মিনিট সময় কম লাগে । ট্রেনে আমার কলিগ একটা ভূতের গল্প বলেছিল । আমার ভূত প্রেতে বিশ্বাস নেই, তবু গল্পটি ভাল লেগেছিল । ওর বাচন ভঙ্গিও খুব ভাল ।লাষ্ট শান্তিপুর লোকাল, যেটা শিয়ালদা থেকে রাত দশটা আটত্রিশে ছাড়ে এবং ফুলিয়াতে রাত বারোটা পঞ্চান্নতে পৌঁছায়, সেই ট্রেনে ওর চেনা একজন ফিরছিলো । সে শান্তিপুর যাবে ।ফুলিয়ার পরে বাথনা হল্ট স্টেশন, রাতের ট্রেন সেখানে দাড়ায়না ।তার পরেই শান্তিপুর স্টেশন ।ফুলিয়াতে ট্রেন থামার পড়ে সে রাতে কামরায় ছিল শুধু দূজন, বন্ধুর চেনা লোক এবং জানালার ধারের সিটে চাদর মুড়ি দেওয়া আরেকজন ।বন্ধুর চেনা লোকটির ভয় ভয় করছিলো, আলাপ জমানোর জন্য চাদর পড়া লোকটির কাছে বসে জিগ্যেস করলো দাদা কি শান্তিপুরেই থাকেন ? কোন উত্তর নেই ।আবার বললো, দাদা ভয় পাবেন না, আমি শান্তিপুর লক্ষ্মীতলা পাড়ায় থাকি , অধমের নাম অগ্নীশ্বর বসাক ।লোকটা তাও কোন উত্তর দিচ্ছেনা দেখে অগ্নীশ্বর লোকটাকে ধাক্কা দিতেই দেখে কেউ কোথাও নেই।অগ্নীশ্বরতো ভয়ের চোটে অজ্ঞান হয়ে ট্রেনের মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো ।ট্রেন শান্তিপুর থামার পড়ে রেলপুলিশ অচৈতন্য অগ্নীশ্বরকে উদ্ধার করে শান্তিপুর হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়, তারপর বাড়ীর লোকেরা আসে।এখনো অগ্নীশ্বর একা কোথাও যায়না এবং রাত হওয়ার আগেই বাড়ী ফিরে আসে । লাষ্ট শান্তিপুর লোকালের লোকেরা সবাই দলবদ্ধভাবে এককামরায় উঠে এবং কয়েকজন মিলে বাড়ী যায় ।


আচ্ছা আমি এসব কথা ভাবছি কেন ? এবার আমার শিবেনদার কথা মনে পড়লো ।শিবেনদা অর্থাৎ শিবেন্দ্রনাথ কবিরাজ । ঠিক তিন বছর আগের কথা । আমি জনগননার কাজ করছিলাম। শিবেনদারও জনগননার কাজ ছিল ।কিন্তু সেই রবিবারে শিবেনদা হাইস্কুলের টিচার সমীরণ বিশ্বাসের নতুন কেনা মারুতি গাড়ী চেপে সকালবেলা কৃষ্ননগর গিয়েছিল তফশিলী জাতি / উপজাতি সন্মেলনে যোগদিতে ।সমীরণ বিশ্বাস নিজেই গাড়ী চালিয়ে নিয়ে গেছে , যদিও তার গাড়ী চালানোর লাইসেন্স নেই । শিবেনদা আমার কলিগ, আমার পাশের স্কুলে শিক্ষকতা করে । শিবেনদার ছোট এক ভাই আমার সাথে পড়তো , আমার বন্ধু , তাই আমি শিবেনদা বলেই ডাকি, আমাদের সম্পর্কও খুব ভাল । ২০১০ সালের এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখ , রবিবার , বিকেল ৫টা । হঠাৎ স্বপন ঘোষের ফোন এলো শিবেনদাদের গাড়ী বাথনার কাছে পেট্রোল পাম্প থেকে পেট্রোল নিয়ে বেড়োতে গিয়ে দূর্ঘটনায় পড়েছে ।সব কাজ ফেলে স্কুটার নিয়ে ছুটলাম ।ততক্ষনে সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে ।ছুটলাম শান্তিপুর হাসপাতালে ।গিয়ে দেখি হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে আছে শিবেনদার লাশ ! অপটু হাতে ড্রাইভ করতে গিয়ে এক লরির সাথে ধাক্কা লাগায় সমীরণ বিশ্বাস । বাদিকে ছিল শিবেনদা এবং কাবলুর বাবা আর ডাক কর্মী মহাদেব বিশ্বাস । তিনজনেই মারা যায় ।ডানদিকে ড্রাইভ করছিল সমীরণ বিশ্বাস ,পিছনে ছিল তার ছেলে । শেষ মুহূর্তে গাড়ী ঘুরিয়ে নিজেদের বাঁচায় সমীরণ বিশ্বাস । রাতে পোষ্টমর্টেম হবেনা, তাই মর্গের ড্র্রয়ারে রাখতে হবে । শিবেনদাকে কোলে তুলে নিয়ে ড্রয়ারে ঢোকাতে নিয়ে গেলাম ।ড্রয়ারে ঢোকানোর সময় জুতো জোড়া ফেলে দিতে হ’ল।রাতে বাড়ী ফিরে বিছানায় যেতে বারোটা বেজে গেল ।রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ ঘুম ভেঙ্গে গেল ।মনে হ’ল শিবেনদা আমায় ডাকছে । ঘর খুলে বাইরে বেড়োলাম ।দেখি শিবেনদা খালি পায়ে ছায়ামুর্তির মতো দাড়িয়ে ।ইশারায় যেন বলছে , ধীমান আমার জুতো কোথায় ? ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটছে আর শিবেনদার ছায়ামুর্তি ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে । ভয়ে হাড় হিম হয়ে গেল । কে যেন বলেছিল অন্ধকার জমে ভুত হয় ! অনেকদিন একা ঘুমোতে পারিনি । গত ২০১২ সালের ১৯শে অক্টোবর ,শুক্রবার, শিবেনদার মেয়ে সহেলি কম্পেনসেশন গ্রাউন্ডে আমাদের স্কুলেই শিক্ষকতার কাজ পেয়েছে ।এই মেয়ে বাবার মৃত্যুর পড়ে হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল
।ওকে দেখলেই খালি শিবেনদার কথা মনে পড়ে ।


এই সব ভাবতে ভাবতে সাড়ে তিনটা বেজে গেল ।হাটতে বের হলাম ।কেন যেন স্টেশনের দিকে হাঁটা লাগালাম ।মনে পড়ে গেল কাল রাতদশটায় ট্রেন থেকে নেমে বাড়ী ফেরার সময় পাইপ ফ্যাকটরির মাঠ থেকে কয়েকজন দুষ্কৃতি বেড়িয়ে আমার কাছে টাকা চেয়েছিল , আমার সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয় ।ওদের একজন পিছন থেকে আমার মাথায় রড দিয়ে মারে , আমি অজ্ঞান হয়ে যাই । জ্ঞান ফিরে বাড়ী ফিরতে তাই দেরী হয়েছিল ! পাইপ ফ্যাক্টরির মাঠের কাছে আসতেই দেখি কিছু মানুষের জটলা । একজন বলছে একটা লাশ পড়ে আছে , আমি এগিয়ে গেলাম । এটা কাল রাতে যেখানে ঝামেলা হয়েছিল সেই জায়গা । আচ্ছা এই যে রাতে আমি বাড়ী ঢুকলাম , আজ সকালে বেড়োলাম কেউ টের পেলোনা কেন ? আরে আমি তো দরজা খুলিনি ! তাহলে ঢুকলাম বা বেড়োলাম কি করে ! তখুনি কে যেন লাশের মুখে আলো ফেললো, চমকে গিয়ে দেখি ওটা আমার মুখ ! নিজের দিকে তাকালাম , ভোরের আলো তখন ফুটতে শুরু করেছে । নতুন প্রভাতের সেই আলোতে
আমার শরীর মিলিয়ে যাচ্ছে ! ক্রমশঃ আমি বিলিয়মান হয়ে যাচ্ছিলাম , তখন শেষ বারের মত মা বাবার কথা মনে পড়লো । তারা আমার জন্য খুব কষ্ট পাবেন ।


মা বাবা , বিশ্বাস কর মরণের পরে আর কিছু নেই , মাটি জল বায়ুতে তৈরী এই দেহ আবার মাটি জল বায়ুতেই মিশে যায় ।কেউ ফিরে আসেনা ,আসতে পারেনা ! এই মাটি জল বায়ু আবার নতুন জীবন গড়ে ।জানি এই সত্য বিশ্বাস করা কঠিন , এজন্য অনেকেই কল্প কথা ফাঁদে । জ্ঞানীরা সব জানেন , তারা সব বলে এবং লিখে গেছেন , কিন্তু বাবা, জ্ঞানের সেই আলোতো অজ্ঞানের অন্ধকারে ঢাকা ! শিক্ষার আলোয় অন্ধকার দূর হয়ে যায় , তাই সবাইকে প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া দরকার , সেই শিক্ষা অন্ধকার দূর করে আনবে নতুন প্রভাত । তোমাদের চিন্তায় মননে আমি বেঁচে থাকবো , তাও যদি কষ্ট হয় তবে ভোরের মধুর বাতাস বইলে ভেবো এই বাভাসে মিশে আছে আমার আমার ছেলে !


ধীরে ধীরে আমি মিশে গেলাম মাটি জল আলো হাওয়ায় , যা দিয়ে আমি তৈরী হয়েছিলাম ।